Ads



ব্রহ্মণ কেন সকলের দ্বারা শ্রদ্ধেয় এবং চন্ডাল কেন ঘৃণ্য?

ব্রাহ্মণ সম্পর্কে সমাজে অনেক অপবাদ চর্চা করা হয়। বলা হয়, ব্রাহ্মণরা নিজেদের সুবিধার্থে শাস্ত্র রচনা করে সমাজে এক সময় শূদ্র, কিংবা নিচু জাতির ওপর অত্যাচার করে এসেছে। এই শাস্ত্র রচনা করে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথায় যুক্তি থাকলেও, কোনো প্রমাণ নেই। শাস্ত্রে তো অনেক কথাই লেখা আছে। কিন্তু বাছা বাছা কথা তুলে অপবাদ ছড়ালে মিথ্যাকে সত্য বলে স্থাপন করা হবে না।  

যে সমাজ মিলে মিশে থাকতো, যে সমাজের নীতিতে শূদ্রের হাতে অশৌচ দূর হতো। অজ্ঞানতা আর বিদেশি হস্তক্ষেপে সেটা সমাজের কলঙ্কে পরিণত হয়েছিল। মুসলিম আমলে যা হয়নি, ইংরেজ আমলে সেটা হয়েছে। ইংরেজরা শাস্ত্রগুলো বিকৃত করে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এই ভুল বোঝাবুঝির কারণে এখন শূদ্র ব্রহ্মণ একে অপরের শত্রু।

Image from Unsplash Hindu Brahmin Priests.

ব্রহ্মণ, চার বর্ণের মধ্যে উচ্চবর্ন। ব্রাহ্মণ থেকেই অন্যান্য বর্ণের উৎপত্তি। তাই, মনুস্মৃতিতে ব্রাহ্মণকে জ্যেষ্ঠ বলা হয়েছে।  মহাভারতের শান্তি পর্বের ১৮৮ অধ্যায়ে বর্ন কিভাবে জন্ম হয়েছে, তার বর্ননা করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র: বর্ণাশ্রম)

ভৃগুরুবাচ—

অস্যজদ ব্রাহ্মণানের পূৰ্ব্বং ব্রহ্মা প্রজাপতীন্ । আত্মভেজোঽভিনির ত্তান্ ভাস্করাগ্নিসমপ্রভান্ ॥ ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়া বৈদ্যাঃ শূদ্রাশ্চ দ্বিজসত্তম। যে চান্তে ভূতসঙ্ঘানাং বর্ণাস্তাং শ্চাপি নিৰ্ম্মমে ॥


“ব্রহ্মা প্রথমে সূর্য্য এবং অগ্নির সমান তেজস্বী আত্মবলে বলীয়ান্ প্রজাপতি ব্রাহ্মণ নির্মাণ করেন। তৎপর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং অন্যান্য ভূতগণের নির্মাণ করেন। ” ভরদ্বাজ  প্রশ্ন করলেন,---“স্বেদ, মূত্র, পুরীষ, শ্লেষ্মা প্রভৃতি সকলের দেহেই সমান ক্ষরিত হয়, সুতরাং বর্ণবিভেদ কি প্রকারে সঙ্গত হয় ?”

 ভৃগু উত্তরে বলিতেছেন:―

ন বিশেষোঽস্তি বর্ণানাং সৰ্ব্বং ব্রাহ্মমিদং জগৎ । ব্রহ্মণা পূৰ্ব্বসৃষ্টং হি কৰ্ম্মভিৰ্ব্বৰ্ণতাং গতং ॥ 

শুরুতে বর্ণের কোনো বিশেষত্ব ছিলো না। সর্বত্র জগৎ ব্রহ্মময় ছিলো। সৃষ্টির পূর্বে ব্রাহ্মণ থেকে বিভিন্ন কর্মভেদে বর্ন এসেছে

কামভোগপ্রিয়াস্তীক্ষ্ণাঃ ক্রোধনাঃ প্রিয়সাহাঃ । ত্যক্তস্বধর্ম্মারক্তাঙ্গাস্তে দ্বিজাঃ ক্ষত্ৰতাং গতাঃ ॥

সেই ব্রাহ্মণেরা স্বধর্ম ত্যাগ করে কম, ভোগ, ক্রোধ প্রিয় ক্ষত্রিয় রক্তের জন্ম হয়। 

গোভ্যো বৃত্তিং সমাস্থায় পীতাঃ কৃষ্যুপজীবিনঃ। স্বধৰ্ম্মান্নানুতিষ্ঠত্তি তে দ্বিজা বৈশ্যতাং গতাঃ ৷৷ 

স্বধর্ম ত্যাগ করে যে সকল ব্রহ্মণ গো-পালন, কৃষি কার্য কে জীবীকা হিসেবে গ্রহণ করেন। তারাই বৈশ্য হয়ে যায়। 

হিংসানৃতপ্রিয়া লুব্ধা: সৰ্ব্বকর্ম্মোপজীবিনঃ। কৃষ্ণাঃ শৌচপরিভ্রষ্টা স্তে দ্বিজাঃ শূদ্রতাং গতাঃ ॥

হিংস প্রিয়, নৃত্য প্রিয় ,শৌচ ভ্রষ্ট,  সর্ব্বকর্মকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করা দ্বিজরা শূদ্র হয়ে গেল।

অতএব, সৃষ্টির প্রথমে একমাত্র (সৎ গুণ) ব্রাহ্মণ বর্ণই ছিল। কারণ উহা সত্ত্বগুণের অবস্থা। তাঁহারা গুণজনিত কৰ্ম্মপ্রভাবে অন্যান্য বর্ণে পরিণত হইয়াছেন। প্রথমে দেখান হয়েছে যে সৃষ্টিধারা ক্রমশঃ কিরূপে সত্ত্ব হইতে সত্ত্ব-রজঃ ইত্যাদি ভেদে অবরোহিণী গতিতে নামিয়া আসে; এখানেও তাহাই বর্ণিত হল। 

প্রথমে নিবৃত্তিপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ উৎপন্ন হন, পরে প্রবৃত্তি পরায়ণ ব্রাহ্মণগণ উৎপন্ন হন। তাঁহাদের ভিতর স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ তিন দেহের পূর্ণ উৎকর্ষ থাকায় তাঁহারা পূর্ণ ব্রাহ্মণ নামেই অভিহিত ছিলেন। সৃষ্টির ধারা ক্রমশঃ নীচাভিমুখী হইয়া গুণত্রয়ের সংমিশ্রণে অন্যান্য বর্ণের উৎপত্তি হয়। তাহাদের জ্ঞান, মন এবং শরীর তিনেরই উপর তাহার ক্রিয়া পতিত হতে থাকে । 

কাম, ভোগ, তিতিক্ষা, ক্রোধ প্রীয় ব্রাহ্মণের রক্ত থেকে ক্ষত্রিয় জন্ম নেয়।

সুতরাং ক্রমশঃ তদভাবে ভাবিত হইয়া অর্থাৎ গুণ পরিণামে তাঁহারা ভ্রমরকীটের ন্যায় তজ্জাতীয়ত্ব প্রাপ্ত হন । শাস্ত্রদৃষ্টে আমরা দেখিতে পাই যে নন্দীশ্বর উৎকট তপস্যার ফলে তজ্জন্মেই দেবদেহ লাভ করেন এবং নহুষ পাপফলে তির্য্যযোনি।

তাই ব্রহ্মণ হয়েছে যে একেবারে মাথায় তুলে রাখতে হবে, আবার আমি শূদ্র বলে যে আমাকে গ্লানি করতে হবে, তা কিন্তু নয়। অত্রিসংহিতায় দশপ্রকার ব্রাহ্মণের লক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তা'র মধ্যে দুই একটী উল্লেখ করে শাস্ত্র এবং যুক্তিসঙ্গত মীমাংসা দেখান হলো ৷  যথা :-

দেবো মুনির্দ্বিজো রাজা বৈশ্যঃ শূদ্রো নিষাদকঃ । পশুয়েচ্ছোঽবি চাণ্ডালো বিপ্রা দশবিধাঃ স্বতাঃ ॥” ৩৬৩

অর্থাৎ,  ব্রাহ্মণ দশপ্রকার যথাক্রমে দেব, মুনি, দ্বিজ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, নিষাদ, পশু, স্লেচ্ছ ও চণ্ডাল।' এরপর বলা হয়েছে:

সন্ধ্যাং স্নানং জপং হোমং দেবতানিত্যপূজনম্ । অতিথিং বৈশ্যদেবঞ্চ দেবব্রাহ্মণ উচ্যতে ॥ ৩৬৪ 

যে ব্রহ্মণ নিত্য সন্ধ্যা বন্দনা, স্নান, জপ, হোম, এবং দেবতার উপাসনা করেন, অতিথির সৎকার করেন। তাঁকে  বৈশ্য বা দেবব্রহ্মণ বলা হয়।

বেদান্তং পঠতে নিত্যং সর্ব্বসঙ্গং পরিত্যজেৎ সাঙ্খ্যযোগবিচারস্থঃ স বিপ্রো দ্বিজ উচ্যতে | ৩৬৭ 

যিনি রোজ সর্বসঙ্গ ত্যাগ করে, বেদান্ত বা উপনিষদ পাঠ্য করে, সংখ্যযোগ বিচার করেন। তাঁকে বিপ্র ব্রহ্মণ বলা হয়।

ব্রহ্মতত্ত্বং ন জানাতি ব্রহ্মসূত্রেণ গৰ্ব্বিতঃ । তেনৈব স চ পাপেন বিপ্রঃ পশুরুদাহৃতঃ ॥ ৩৭২ 

যে ব্রহ্মণ ব্রহ্ম তত্ত্ব না জেনে কেবলমাত্র ব্রহ্মসূত্র নিয়ে গর্বিত বোধ করে। এমন পাপি বিপ্র বা ব্রাহ্মণকে পশু বলা হয়।

ক্রিয়াহীনশ্চ মূর্খশ্চ সৰ্ব্বকৰ্ম্মবিবজ্জিতঃ ।নিদয়ঃ সৰ্ব্বভূতেষু বিপ্রশ্চাণ্ডাল উচ্যতে ॥” ৩৭৪

ক্রিয়াহীন, মূর্খ, নিষ্কর্মা, নির্দয় বিপ্র বা ব্রাহ্মণকে চন্ডাল বলা হয়।

অতএব, যে চন্ডালকে সমাজে অস্পৃশ্য বলা হয়। সে বা তাঁর পূর্বপুরুষ ব্রহ্মণই ছিলো। ক্রিয়াহীন, মূর্খ, নিষ্কর্মা, নির্দয় বিপ্র বা ব্রাহ্মণকে অবজ্ঞা করে তাঁকে সমাজ থেকে বঞ্চিত করা হতো। আজ যেভাবে একজন মাতাল, মূর্খ, জুয়াড়িকে সমাজ দেখে। সেই সময় একজন চন্ডালের প্রতি সমাজের একই ভাব ছিলো।

মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে:

আপদকাল ছাড়া ব্রহ্মণ এমন কোনো জীবিকা গ্রহণ করবে না যাতে প্রাণীদের কোনো প্রকার অনিষ্ট হয়। ব্রহ্মণ নিজের শরীরে ক্লেশ না দিয়ে কেবলমাত্র প্রাণ ধারণের জন্য অর্থ সঞ্চয় করবেন। যজ্ঞ অন্ন, দান গ্রহণ, ভিক্ষা, চাষাবাদ, এবং খুব বেশী হলে, আপদকালে বাণিজ্য দ্বারা ব্রহ্মণ জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। পরের সেবা (যেমন: চাকরী, দাসত্ব) ব্রাহ্মণ করবে না। ব্রহ্মণ ধন সঞ্চয় করতে পারবে না। ব্রহ্মণ নিজের জীবনের প্রথম চারভাগ গুরুগৃহে এবং পরবর্তী দ্বিতীয় ভাগ বিবাহিত অবস্থায় নিজের গৃহে বসবাস করবে। অর্থাৎ, ব্রাহ্মণের জীবন আজকের কথিত ব্রাহ্মণদের মতো ছিলো না। 

সময় বদলেছে পরিস্থিতি বদলে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে ব্রাহ্মণের রং ঢং, বদলে গেছে। অজ্ঞানতা আর কুশিক্ষাই হিন্দু ধর্মে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে। তাই, হিন্দু চেতনার জাগরণের খুব দরকার।  আশাকরি আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস সেই চেতনায় সামান্য হলেও সাহায্য করবে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন