Ads



জ্ঞানব্যাপি মসজিদের ইতিহাস থেকে বর্তমান বিবাদ। যেখানে পাওয়া গেছে স্বস্তিক এবং ত্রিশূল।

'জ্ঞানব্যাপি' একটি কূপের নাম।  যা অবস্থান করছে কাশীর বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির প্রাঙ্গনে। প্রাচীন কাল থেকেই এই বিশ্বনাথ মন্দির এবং ভগবান শিবের জ্যোতির্লিঙ্গের পূজা হয়ে আসছে।  সনাতন হিন্দু ধর্মের ভগবান শিবের ৬৪টি জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে এটি একটি। ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের কথা আমরা সকলেই জানি কিন্তু বাস্তবে সমগ্র ভারতে ৬৪টি জ্যোতির্লিঙ্গ আছে। জ্যোতির্লিঙ্গ ভগবান শিবের সাক্ষাৎ স্বরূপ। ভগবান শিব যখনই ধরা ধামে প্রকট হতেন, সেই স্থানে একটি জ্যোতির্লিঙ্গ প্রকট হতো এবং সেখানেই তিনি বিলয় হতেন। পুরাণে কথিত আছে ভগবান শিব কৈলাশ ছেড়ে বেনারসের এই জ্যোতির্লিঙ্গে এসে অবস্থান করছেন। স্কন্দ পূরণে  ভগবান স্কন্দ  অর্থাৎ কার্তিকেয় অগস্ত্য ঋষিকে যখন ভগবান শিবের গাথা শোনাচ্ছিলেন সেখানেই এই জ্ঞানব্যাপীর কাশী বিশ্বনাথের জ্যোতির্লিঙ্গের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সত্যযুগে ভগবান শিব এই জ্যোতির্লিঙ্গের পাশেই নিজের ত্রিশূল দ্বারা ভূমিতে আঘাত করে একটি কূপ খনন করেছিলেন। সেই কূপ জ্ঞানব্যাপী কূপ হিসেবে পরিচিত। এই জ্ঞানব্যাপী কূপের জল অমৃতের মতো মিষ্টি এবং আত্মাকে পবিত্র করার মতো শীতল ছিল। এই জল থেকে পদ্ম ফুলের মতো সুগন্ধ সর্বদা নির্গত হয় বলে বর্ণিত হয়েছে। ভগবান শিব বলে গেছেন, "যে বুদ্ধিমান ব্যক্তি এই পবিত্র জ্ঞানব্যাপী কূপের জল দ্বারা এই জ্যোতির্লিঙ্গে ঢালবেন সেই ব্যক্তি অবশ্যই মোক্ষ প্রাপ্ত হবেন।"

এই শহরের প্রাচীনত্ব খৃষ্টপূর্ব 2000 বছর আগে। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র তো বটেই, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মশাস্ত্রেও এই কাশি শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। হিউয়েন স্যাং তার বর্ণনায় কাশির কথা উল্লেখ করছেন। তাহলে ভাবুন এই শহর কত প্রাচীন।

জ্ঞানব্যাপি মন্দির-মসজিদ বিবাদিত:

বর্তমানে এই কাশি বিশ্বনাথ মন্দির এবং তাঁর পার্শ্ববর্তী জ্ঞানব্যাপি মসজিদকে নিয়ে হাই কোর্টে বিচার চলছিলো। হিন্দুপক্ষের দাবি এই জ্ঞানব্যাপী মসজিদের নীচে হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। মুসলিম ওয়াখাব বোর্ডের তরফ থেকে এই দাবিকে খারিজ করা হয়েছে। মুসলিম পক্ষ এই দাবিকে অযৌক্তিক এবং রাজনৈতিক সংকট এড়িয়ে চলতে সরকারের কেরামতি বলে মোদ্দা ঘুরানোর ট্যাকটিস বলে ডিফেন্ড করেছে। তাদের বক্তব্য, কোনো বিবাদিত স্থানে, বা অন্যের সম্পত্তিতে কখনো মসজিদ নির্মাণ হয় না। কিন্তু ইতিহাস কি বলে?



ইতিহাস যখন সাক্ষী দেয়:

মিথ্যার অস্তিত্ব নেই আর সত্যের বিকল্প নেই। ইতিহাসকে বিকৃত করা যেতে পারে, ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু যখন ইতিহাস নিজেই নিজের সাক্ষী দেয়। তখন সেই মিথ্যাচারী ঐতিহাসিকদের মুখ ঢাকার আর কোনো জায়গা থাকে না। 

১. ঔরঙ্গজেব আদেশনামা

১৬৬০ খৃস্টাব্দে মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আদেশে এই জ্ঞানব্যাপি মন্দিরে আক্রমন চালিয়ে তাঁর ধ্বংসস্তূপেই একটি মসজিদ স্থাপন করেছিলো। এর তথ্য কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে রাখা আছে। একটি মসজিদ আজ ওই মন্দির প্রাঙ্গনের পাশেই অবস্থান করছে। যাকে জ্ঞানব্যাপি মসজিদ বলা হয়। এটিই এই বিবাদিত মসজিদ যা ঔরঙ্গজেব বানিয়েছে। বহুবার এই মন্দিরে আক্রমণ করা হয়েছে এবং প্রচুর ধন সহ সোনা লুঠ করা হয়েছে। তারপর রাজা জয় সিং, রানী  এর পুনঃ পুনঃ জীর্ণদ্ধার করেন।

২. ভগবান নন্দীর তপস্যার ফল:

সাধারণত যে কোনো শিব মন্দিরর সামনে একটি ভগবান নন্দীর মূর্তি স্থ্যাপিত হয়। সেই মূর্তিটি সর্বদা ভগবান শিবের দিকে মুখ করে থাকে। এই মন্দির প্রাঙ্গণেও একটি ভগবান নন্দীর মূর্তি আছে যেটি মসজিদের দিকে মুখ করে আছে। মসজিদের গায়ে হিন্দু মন্দিরের ভাস্কর্য, লতা-পাতা, সাপ, এবং অষ্টমুখী স্তম্ভ আজো বিদ্যমান। ভক্তরা এই ঘটনাকে শিব সেবক নন্দীর তপস্যা বলে উল্লেখ করেছেন।

পর্যটকদের সাক্ষী:

বহু বছর ধরে হিন্দু শ্রদ্ধালুরা এই মন্দিরে আসেন। দেশ দেশান্তর থেকে পর্যটকরা আসেন এবং এই বিচিত্র দৃশ্য কারোই অদেখা নয়। 1991 সালে একটি পিটিশন দায়ের করা হয় এবং এই বিতর্ক নিয়ে কোর্টে মামলা চলতে থাকে। ৩০ বছর পর 2021 সালে এই মন্দিরের সার্ভে করা হয়। যেখানে মসজিদ পরিসরে সার্ভে করার কথা ওঠে। 

2022এর সার্ভে এবং ফলাফল:

2022 সালে কিছু শর্ত সাপেক্ষে আবার একটি সার্ভে কমিটি গঠন করা হয় যেখানে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় পক্ষের মোট 5 জন সাক্ষী রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম পক্ষের তরফ থেকে এলাহাবাদ হাইকোর্টে Worship Act 1991 অজুহাতে এই সার্ভে হ্রদ করা হয়।

এরপর 5 জন মহিলা পূনরায় কোর্টে একটি আর্জি পেশ করে বলেন। মসজিদের দেওয়ালে মাতা গৌরীর রোজ পূজা করতে  কোর্টের কাছে আদেশ চায়। এরপর পুণরায় ওই মামলা বেগ পায়। এবার সুপ্রিম কোর্টের আদেশে একটি সার্ভে টিম গঠন করা হয় এবং খুবই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সার্ভে করার জন্য মসজিদের ভূগর্ভস্থ ঘর গুলো খোলার আদেশ দেওয়া হয়। মুসলমানদের এই সময় মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ থাকেনি তবে জমায়েত কম করা হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী তারা নিজেদের নামাজ আদায় করেছেন এবং সার্ভে টিম খুব গুপ্ত ভাবে নিজের সার্ভে সম্পাদন করেছে। সার্ভে করতে গিয়ে বাজুখানায় একটি কুওয়ার ভেতর একটি শিবলিঙ্গ আকারের একটি স্তম্ভ পাওয়া যায়। মুসলিম পক্ষের দাবি এটি একটি ফোয়ারা। কিন্তু হিন্দু পক্ষ এটিকেই বাবা বিশ্বনাথ বলে দাবী করতে থাকে। এই নিয়ে চর্চা এবং তর্ক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক মুসলিম তথা বামপন্থী নেতা, মন্ত্রী, সাংবাদিকদের দ্বারা হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার চেষ্টা করা হয়। হিন্দুপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ফলে ভারতীয় ধর্মীয় অবমাননা দণ্ডবিধি অনুসারে তাদের অনেকেই জেলে পুরে দেওয়া হয়।

AIMM সংসদ ওয়াসাদুদ্দিন অবেসির তরফ থেকে Worship Act 1991 অজুহাত দেখিয়ে এই সার্ভে বন্ধ করার যুক্তি পেশ করা হলে  BJP মুখপাত্র সন্দীপ পাত্রা তাঁর উত্তরে বলেন, Worship Act 1991 -এর section 4(iii) ব্যতিক্রম বিধান রয়েছে। অধিগ্রহণ করা ধর্মস্থল গুলো যেখানে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য গুলো খন্ডিত হয়। সেখানে এই বিধান কার্যকরী হবে না। সেই স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষার তাগিদে ASI এর নিরীক্ষনে Worship Act 1991এর সকল আইন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।  

April 21, 2022 তারিখে সুপ্রিম কোর্টে বিচার হয় কাশী বিশ্বনাথ ধামের জ্ঞান ব্যাপী মসজিদ আসলেই মন্দিরের অংশ। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন